শাহেন শাহ-এ-গজল মেহেদী হাসানের মৃত্যো বার্ষিকী ১৩ই জুলাইঃ পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীর কামনাঃ চাই মূল্যায়নঃ সম্মান ও সম্মাননা

July 11, 2017,

মুজিবুর রহমান মুজিব॥ দুই হাজার বারো সালের তেরোই জুলাই দীর্ঘ রুগভোগের পর পরিনত বয়সেই মহান মৃত্যোকে আলিঙ্গঁন করেন উপমহাদেশীয় রাগ সঙ্গীঁতের জীবন্ত কিংবদন্তি গজল স¤্রাট মেহেদী হাসান। ৮৫ বৎসর ১১ মাস ১৪ দিনের সফল মানব জীবন শেষে শিল্পী মেহেদী হাসানের মৃত্যো পরিনত বয়সের মৃত্যো হলেও তাঁর মহাপ্রয়ানে উপমহাদেশীয় সঙ্গীঁত বিশেষতঃ রাগ সঙ্গীঁতের ভূবনে যে অপূরনীয় ক্ষতি হল তা সহজে পূরন হবার নয়। গজল স¤্রাটের পঞ্চম মৃত্যো বার্ষিকী তে তাঁর উজ্জল স্মৃতির প্রতি সুগভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। মহান মালিক তার বেহেশত নসীব করুন এই মোনাজাত করছি।
জাত শিল্পী মেহেদী হাসানের জন্ম এক ঐতিহ্যবাহী শিল্পী পরিবারে। জন্মের পর মেহেদী হাসান অক্ষর জ্ঞানের পূর্বেই সারেগামা-সুরলহরী সুরের ভূবনের সঙ্গেঁ পরিচিত হন। ১৯২৭ সালের ১৮ই জুলাই আধুনিক ভারত বর্ষের রাজস্থানের ঝুনঝুন জেলাধীন লুনা গ্রামে কালা ওয়ান্ত সঙ্গীত পরিবারে শিশু মেহেদী হাসানের জন্ম। তার পিতা দ্দূপদ সঙ্গীতের প্রখ্যাত পন্ডিত ওস্তাদ আজিম আলী খাঁন। মেহেদী হাসানের চাচা ওস্তাদ ইসমাইল আলী খাঁন ও দ্দূপদ সঙ্গীতের খ্যাতিমান পন্ডিত ছিলেন। ফলতঃ জন্মের পর থেকে পারিবারিক পরিবেশে সঙ্গীত চর্চার মাধ্যমে বেড়ে উঠেন তিনি। শিশু শিল্পী মেহেদী হাসানের সঙ্গীতে হাতে খড়ি বাবা-চাচার কাছেই। বাপ চাচাই মেহেদী হাসানের সঙ্গীত গুরু। বারোদার মহারাজা সেকালে উপমহাদেশীয় শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির উদার পৃষ্টপোষক ছিলেন। মেহেদী হাসানও বাল্যকালেই বারোদার মহারাজার দরবারে প্রথম গজল পরিবেশন করে সর্বত্র সুখ্যাতি অর্জন করেন। অর্ধ ঘন্টা ব্যাপী কিশোর মেহেদী হাসান শিল্প রসিক বারোদার মহারাজার সামনে রাগ বসন্ত অতঃপর ধ্রুপদীয় খেয়াল পরিশেন করতঃ শিল্প রসিকদের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন। বাল্যকালেই সঙ্গীঁত জীবনের শুরুতে মেহেদী হাসান বারোদার মহারাজার প্রশংসা প্রাপ্ত হয়ে সঙ্গীতের ভূবনে হাটি হাটি পা-পা-করে সামনের দিকে এগিয়ে যান।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তি ও পাকিস্তান প্রতিষ্টার পর মেহেদী হাসানের পরিবার বর্গ ভারতবর্ষ ত্যাগ করে পাকিস্তানে চলে আসেন। বসতি স্থাপন করেন শাহিওয়াল এলাকায়। বালক মেহেদী হাসান তখন মাত্র বিশ বছর বয়সের যুবক। নবীন রাষ্ট্র পাকিস্তানে এসে আত্বীয় স্বজনহীন অবস্থায় অর্থ কষ্টের সম্মুখীন হন মেহেদী হাসানের পরিবার। জীবন সংগ্রামে নামতে হয় শিল্পী মেহেদী হাসানকে। পারিবারিক জীবনের প্রাথমিক পর্য্যায়ে নিদারুন দূঃখ কষ্ট ও পারিবারিক বিশৃঙ্খলার মাঝেও জাত শিল্পী মেহেদী হাসান সঙ্গীত চর্চা ত্যাগ করেন নি। শিল্পী জীবনের শুরুতে মেহেদী হাসান লাহোরের বেশ কটি অনুষ্টানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। তবুও তাতে সাফল্য আসেনি-সাড়া পাওয়া যায় নি বোদ্ধা- দর্শক শ্রেুাতার।
১৯৫৭ সালে শিল্পী মেহেদী হাসান রেডিয়ো পাকিস্তান করাচী ষ্টুডিয়োতে অডিশনের সুযোগ পেয়ে ঠুমরি, রাগ খাম্বাজ, তিলক কামোদ গেয়ে শোনান। রেডিয়ো কর্ম্মকর্তা জেড. বুখারি ও রফিক আনোয়ার নবীন শিল্পী মেহেদী হাসানের যাদূগরি কন্ঠে বিমুগ্ধ হয়ে এ-গ্রেড এর শিল্পী হিসাবে মাসিক ৩৫ রুপী বেতনে চাকরী দেন। খোদাপ্রদত্ত মেহেদী হাসানের যাদূগরি কন্ঠ, তাঁর গলায় “আকার”- ঠুমরিও গজলের জন্যই যুৎসই ছিল। তাই শিল্পী মেহেদী হাসান ক্লাসিক্যেল ও গজলের প্রতি অধিকতর মনোযোগী হয়ে উঠেন। মহান আল্লাহর রহমত ও মেহেরবানী, পিতা-মাতা ওস্তাদের দোয়ার বরকতে মেহেদী হাসান সুরের প্রতি শর্তহীন ভালোবাসা ও আনুগত্য, অবিরাম চর্চা ও অধ্যাবসায়ের ফল ও ফসল আজকের মেহেদী হাসান। গজল স¤্রাট মেহেদী হাসান, শাহেনশায়ে গজল মেহেদী হাসান হিসাবে খ্যাতি ও স্বীকৃতি অর্জন। তার গায়কি, ঢং, আবেগ, নিজস্বধারা ও সুমিষ্ট কন্ঠ গজলের ক্ষেত্রে এক নিজস্ব মেহেদী ঘারানার সৃষ্টি করে। যা অনেকেই “মেহবুব সুর”- বলে আখ্যায়িত করলেন। কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ এর “গুলুমে রাঙ্গঁভারে” উচ্চ মার্গীয় গজলটি শুনে অনেকেই তাক লেগে যান। অবাক হন। তাইত মেহেদী হাসানের সুমিষ্ট গজল ও গায়কিতে বিমুগ্ধ হয়ে উপমহাদেশীয় আধুনিক সঙ্গীঁতের জীবন্ত কিংবদন্তী শ্রদ্ধেয় লতামুঙ্গেঁশকর যথার্থই বলছিলেন -“মেহেদী হাসানের কন্ঠে স্বয়ং বাস করেন ইশ^র”-। উপমহাদেশীয় সঙ্গীঁতের আরেক উজ্জল নক্ষত্র মোঃ রফি (মরহুম) ও যথার্থ বলেছিলেন -“আমরা গান করি আম জনতার জন্য আর মেহেদী হাসান গান করেন আমাদের জন্য”-। এই দুই শিল্পীর উক্তি ও অভিমত থেকে সহজেই প্রতিয়মান হয় গজল স¤্রাট মেহেদী হাসান কত উচ্চ মার্গীয় শিল্পী ছিলেন।
নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রাথমিক যুগে চলচ্চিত্র নির্ম্মান শুরু হলে গজল শিল্পী মেহেদী হাসান পাকিস্তানী চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক শুরু করেন। ফিল্মি গানেও অসম্ভব রকমের জনপ্রিয়তা পান তিনি। পাকিস্তানী চলচ্চিত্রের সর্ব্ব কালের সর্ব্বশ্রেষ্ট প্লেব্যাক সিংগার তিনিই- মেহেদী হাসান, গজল স¤্রাট মেহেদী হাসান। ষাটের দশকে প্রখ্যাত পাকিস্তানী কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ এর লেখা “ফিরিঙ্গিঁ” ছবির গজল “গুলুমে রাঙ্গঁভারে” শিল্পী মেহেদী হাসানকে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা এনে দেয়। পন্ডিত গোলাম কাদিরের কম্পোজিশনে কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজের রচিত  “গুলুমে রাঙ্গঁভারে” গজলটি শাহেনশায়ে গজল মেহেদী হাসানকে অমর করে রাখবে। গজল শিল্পী মেহেদী হাসান রাগ সঙ্গীঁত থেকে প্লেব্যাকে এলেও চলচিত্রের হালকা-অশ্লীল গান তিনি গাননি। প্লেব্যাক-এ-ও মেহেদী হাসান সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ছায়াছবির গানকেও তিনি একটি মর্য্যাদার আসনে অধিষ্টিত করেন।
উর্দ্দূ-হিন্দী ভাষি অবাঙ্গাঁলি মেহেদী হাসানের বাংলাদেশেও অগনিত ভক্ত শ্রোতা আছেন। বাংলাদেশী চলচিত্র ও সঙ্গীঁত জগতের সঙ্গেঁও তার সম্পৃক্ততা রয়েছে। মেহেদী হাসানের গাওয়া বাংলা গান -“হারানো দিনের কথা মনে পড়ে যায়, ঢাকাই চলচিত্র রাজা সাহেব এর “ঢাকো যতনা নয়ন দুহাতে”  এবং “তুমি যে আমার” আধুনিক বাংলাগানের ভক্ত শ্রোতা চীরকাল মনে রাখবেন। বাঙ্গাঁলী জাতি ও বাঙ্গালি সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন শিল্পী মেহেদী হাসান। তাঁর পারিবারিক পদবী খান হলেও তিনি পাকিস্তানী জল্লাদ খাঁন সাহেব ছিলেন না। মেহেদী হাসান খান হলেও তিনি পাকিস্তানী জল্লাদ জেনারেল এহিয়া খান, টিক্কা খানের মত হৃদয়হীন হার্মাদ ছিলেন না, ছিলেন বাংলা ও বাঙ্গাঁলীর প্রতি প্রকৃত অর্থেই সংবেদনশীল। হৃদয়বান। ১৯৮৫ সালে সার্ক সম্মেলনে পাকিস্তানী সঙ্গীঁত প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসাবে ঢাকায় এসেছিলেন গজল স¤্রাট মেহেদী হাসান। ষ্টুডিয়োতে কথোপকথন এবং সাংবাদিকদের স্বাক্ষাতকারে মেহেদী হাসান বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে যে স্বল্প সংখ্যক পাকিস্তানী শিল্পী সাহিত্যিক সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্ম্মি একাত্তোরে পাকিস্তানী গনহত্যার বিরোধী ছিলেন তাঁদের মধ্যে মেহেদী হাসান অন্যতম।
উপমহাদেশীয় সঙ্গীঁত শিল্পিদের মধ্যে মেহেদী হাসান ছিলেন শীর্ষ স্থানীয়। তার গানের সংখ্যা পচিঁশ হাজারেরও অধিক। তিনি ছিলেন বাংলা ও বাঙ্গাঁলির একজন প্রকৃত সুহৃদ। অকৃত্রিম বন্ধু। পত্রিকান্তরে প্রকাশ সর্বকালের এই সর্ব্বশ্রেষ্ট সঙ্গীঁত তারকার মৃত্যোর পর বাংলাদেশী উভয় মিডিয়াই কোন অনুষ্টানাদি স্মরন-বরন জাতীয় কিছুই হয়নি। এটা নিতান্তই দূঃখ ও বেদনাদায়ক।
একজন সাংবাদিক, সাহিত্যিক ক্রীড়াবিদকে বলা হয় একটি দেশের ভ্রাম্যমান বেসরকারি রাষ্ট্রদূত। একজন শিল্পী বিদেশে স্বদেশের ভাবমূর্তি, ইতিহাস, ঐতিহ্য- শিল্প-সংস্কৃতি তুলে ধরেন- বিদেশে স্বদেশের সুনাম ও ইমেজ বৃদ্ধি করেন। একজন শিল্পীর অবদান স্বদেশের সীমারেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনা। ৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর থেকে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক বরাবরই বৈরী। দুদেশের দূতাবাশ ও রাষ্ট্রদূত থাকলেও খুব একটা দূতিয়ালি নেই। পাক-ভারত বৈরী সময়ের মাঝেও পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা, পাকিস্তানের কবি ও দার্শনিক, শিকোওয়া ও জওয়াবে শিকোয়া খ্যাত আল্লামা স্যার মোহাম্মদ ইকবাল কবি হিসাবে ভারত বর্ষে সম্মানিত ও সমাদৃত। কবি ইকবাল রচিত “সারে জাহাসে আচ্ছা হিন্দুস্থাঁ হামারা”- সঙ্গীঁতটি ভারতবর্ষে জাতীয় মর্য্যাদায় “জনমন অধিনায়ক জয়হে ভারত ভাগ্য বিধাতা”র পরে গীত হয়। কবি হিসাবে পাকিস্তানের স্যার মোহাম্মদ ইকবাল ভারত বর্ষেও সমাদৃত। সম্মানিত। অথছ বাংলাদেশে কবি হিসাবে ইকবালের কোন অস্থিত্ব, পরিচিতি চর্চা নেই। বর্তমান প্রজন্ম হয়ত কবি ইকবালের নামই জানেন না। অথছ পূশতু ও উর্দ্দূ সাহিত্যে আল্লামা স্যার মোহাম্মদ ইকবালের ব্যুৎপত্তি ও পান্ডিত্য ইতিহাসের অংশ।
একজন শিল্পীর স্বত্তা, তার অস্থিত্ব ও আবেদন, ভাবানুভূতি ও জীবনদর্শন স্বদেশের সীমারেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। একজন শিল্পীর স্বত্বা ও জীবনবোধ দেশ থেকে দেশান্তরে কাল থেকে কালান্তরে প্রভাব বিস্থার করে। মানবতাবোধ ও বিকষিত জীবনে ইতিবাচক অবদান রাখে। গজল স¤্রাট মেহেদী হাসান একজন কালজয়ী জীবন শিল্পী। পাকিস্তানী মেহেদী হাসান বলে অবজ্ঞা প্রদর্শন নাকসিটকানো কিংবা রাজাকার-যুদ্ধাপরাধী বলে রং তামাশা করার কোন অবকাশ নেই। তাঁর জীবদ্দশায় কথায় কাজে ও সঙ্গীঁত চর্চায় গজল স¤্রাট মেহেদী হাসান বলে গেছেন, দেখিয়ে গেছেন তিনি বাংলা ও বাঙ্গাঁলীর অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন। শুভাকাঙ্খী ছিলেন।
জন্ম-মৃত্যো বার্ষিকী সহ এ দেশেত অনেক কিছুই হয়। জন্ম-মৃত্যো বার্ষিকী অনুষ্টানাদি খুব একটা কম হয় না। রাষ্ট্রীয়ভাবে নয় আমাদের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ভূবন, বিশেষত আমাদের সেটেলাইট চ্যেনেল গুলি কালজয়ী গজল স¤্রাট মেহেদী হাসানের সম্মান ও স্মরনে আলোচনাচক্র ও গজলসন্ধ্যার আয়োজন করতে পারেন। আমাদের মিডিয়া ভবনের কাছে এই দাবী। আশা করি আমাদের রাগ সঙ্গীঁতের বিশেষজ্ঞগন-আমাদের মিডিয়া ভবন এ ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করবেন।
গজল স¤্রাট মেহেদী হাসানের পঞ্চম মৃত্যেুবার্ষীকিতে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
[ ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক সংঘটক। এডভোকেট হাই কোর্ট। সাবেক সভাপতি মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব। মুক্তিযোদ্ধা ]

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com